করোনা সংক্রমন প্রশ্নে সবচেয়ে ভয়ের বিষয় হচ্ছে উপসর্গহীন রোগী। সেই সংকটেই এখন মারাত্মকভাবে ভুগছে বরিশাল। জ্বর, সর্দি, কাশির মতো লক্ষণ ছাড়াই এখানে এধরনের করোনা রোগী ধরা পড়ছে প্রতিদিন। বিষয়টি নিয়ে আতঙ্কগ্রস্ত স্থানীয় স্বাস্থ্য বিভাগ।
করোনা সংক্রান্ত চিকিৎসায় সম্পৃক্ত অনেকের ধারণা, এভাবে উপসর্গহীন অবস্থায় এরইমধ্যে বরিশাল বিভাগে ৪০/৪৫ শতাংশ মানুষ সংক্রমিত হয়েছেন এই ভাইরাসে। তবে কোনরকম উপসর্গ না থাকা আর দৈহিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার কারনে একদিকে তারা যেমন সুস্থ হয়ে উঠেছেন তেমনি তারা যে করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন সেটি হয়তো বুঝতেই পারেননি। মাঝে থেকে এরাই তাদের অজান্তে করোনা ছড়িয়েছেন আরো বহু মানুষের মাঝে।
বরিশালের বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. বাসুদেব কুমার দাস যুগান্তরকে বলেন, নানা রোগের কারণে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতে সেবা নিতে আসা অনেকেরই এখন করোনা পজিটিভ ধরা পড়ছে। করোনাভাইরাসের নির্ধারিত কোনো উপসর্গ তাদের মধ্যে না পাওয়া গেলেও পরীক্ষা করালে দেখা যায় তিনি করোনা আক্রান্ত। এটি বড় রকমের একটি উদ্বেগের কারণ।
বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশ সূত্রে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে এখন পর্যন্ত ৬১ জন পুলিশ সদস্য করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। এদের সঙ্গে রয়েছে অনেকের পরিবারের সদস্যরা।
আক্রান্তদের মধ্যে আছেন এখানকার অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার প্রলয় চিসিম, কোতয়ালী মডেল থানার ওসি তদন্ত আবদুর রহমান মুকুলসহ বেশ কয়েকজন এসআই, এএসআই ও কনস্টেবল।
শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের রিভার্স ট্রান্সক্রিপশন পলিমার্স চেইন রিএ্যাকশন (আরটি পিসিআর) ল্যাব সূত্রে জানা গেছে, বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের যত সদস্যের করোনা পজিটিভ এসেছে তার অধিকাংশই শনাক্ত হয়েছেন বাহিনীর বিধিবদ্ধ নিয়মের নির্ধারিত চেকআপে। করোনা শনাক্ত হওয়া এইসব পুলিশ সদস্যের অনেকেরই কোন উপসর্গ ছিল না। কিন্তু পরীক্ষা করাতে এসে দেখা গেছে যে তারা করোনা পজিটিভ। উপসর্গহীন এই ধরনের রোগীর সংখ্যা প্রায় প্রতিদিনই বাড়ছে।
গত ১১ মে প্রথম বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের উত্তর জোনের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার আবুল কালাম আজাদের গাড়ি চালকের করোনা শনাক্ত হয়। এরপরই বিএমপি সিদ্ধান্ত নেয় ধারাবাহিকভাবে সকল পুলিশ সদস্যের করোনা টেস্ট করানোর। ধারাবাহিক চেকআপ করাতে গিয়ে উপসর্গহীন বহু পুলিশ সদস্যের রিপোর্টে করোনা পজিটিভ পাওয়া যাচ্ছে।
সর্বশেষ করোনা পজিটিভ আসা বরিশাল মেট্রেপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার প্রলয় চিসিম জানান, নূন্যতম কোন লক্ষণ ছিল না তার।
প্রায় প্রতিদিনই পুলিশের অনেক সদস্য করোনায় আক্রান্ত হচ্ছিলেন। তাছাড়া শুরু থেকেই জনসম্পৃক্ত নানা কাজ করছিলেন তিনি। সেই কারনে কৌতুহলবশতঃ গত ২৯ মে করোনা টেস্টের জন্য নমুনা দেন।
৩১ মে রাতে শেবাচিমের ল্যাব থেকে জানানো হয় যে তিনি করোনা পজিটিভ। এই কর্মকর্তা মনে করেন, কমিউনিটি ট্রান্সমিশনের কারণেই তিনি সংক্রমিত হয়েছেন।
পুলিশ সদস্যদের বাইরে গত রোববার শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক অরিন্দম বড়াল, প্রিয়াংকা দাস এবং তৌফিক এলাহি আহাদের রিপোর্টে করেনা পজিটিভ এসেছে। তাদের সঙ্গেও আলাপ করে জানা গেছে যে, দীর্ঘদিন হাসপাতালে দায়িত্ব পালন করায় মনের সন্দেহে করোনা পরীক্ষা করালে ফলাফল পজিটিভ আসে। অথচ তাদের শরীরে করোনার কোনও উপসর্গ ছিল না। আক্রান্তরা মনে করছেন, কভিড-১৯ শুধু বরিশাল বিভাগে নয়, দেশের কোনো অঞ্চলেই এখন আর নিয়ন্ত্রিত নেই।
শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করোনা ইউনিটে কাজ করা দুজন চিকিৎসক বলেন, সবার টেস্ট করানো সম্ভব হলে কত শতাংশ সংক্রমিত তা বলা যেত। এছাড়া কোন মন্তব্য করা অসম্ভব। তবে ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে অনুমান করা যায় মানুষের অবাধ বিচরণ এবং স্বাস্থ্যবিধি অমান্য করায় দক্ষিণাঞ্চলের ৪০/৪৫ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনোভাবে সংক্রমিত হয়ে পড়েছেন।
এই হাসপাতালের আরটি পিসিআর ল্যাবে দায়িত্ব পালন করা একজন নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে বলেন, যারা পরীক্ষা করাতে আসেন তাদের ফলাফলটি জানা যায়। যারা আসেন না তাদের বিষয়ে জানা অসম্ভব। উদাহরণ হিসেবে বলেন, বরিশাল মেট্রোপলিটন পুলিশের বহু সদস্য করোনায় আক্রান্ত হচ্ছেন এমন খবর আমরা প্রতিদিন দেখছি।এই যে প্রতিদিন পুলিশ বাহীনির সদস্যদের কারও না কারও করোনা পজেটিভ আসছে-তার কারন বাহীনির নিয়মেএরা পরীক্ষা করাতে আসছেন। উপসর্গ না থাকায় যদি না আসতেন তাহলে আক্রান্ত ব্যক্তিও জানতে পারতেন না যে তিনি করোনা পজেটিভ।
ল্যাবের দায়িত্বশীল এই কর্মকর্তা মনে করেন, বিপর্যয় থেকে বাঁচতে হলে দক্ষিণাঞ্চলে করোনা পরীক্ষার ল্যাবর সংখ্যা আরও বাড়ানো দরকার। এখানে এখন একটি ল্যাবে পুরো বিভাগের কয়েক কোটি মানুষের করোনা সনাক্তে পরীক্ষা হচ্ছে। অথচ এই ল্যাব প্রতিদিন মাত্র ৯৪টি সোয়াব পরীক্ষা করতে পারে।
স্বাস্থ্য দফতর বলছে, যারা পিসিআর ল্যাবে করোনা পরীক্ষা করাতে এসেছেন তার মধ্যে ৫/৬ শতাংশ মানুষের শরীরে করেনা শনাক্ত এসেছে।
বরিশালে এখন পর্যন্ত ১০ হাজার ৮৬৬ জন মানুষের করোনা পরীক্ষা করা হয়েছে। এদের মধ্যে ৬০৮জনের শরীরে উপস্থিতি পাওয়া গেছে করোনার। এখানে ৬ জেলার ৪২ উপজেলায় বসবাসকারী কয়েক কোটি মানুষের পরীক্ষা করা হলে ফলাফল কোথায় গিয়ে দাঁড়াতো তা বলার অপেক্ষা রাখেনা।
বরিশাল নাগরিক পরিষদের সদস্য সচিব ডা. মিজানুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, একটি কথা মাথায় রাখতে হবে যে যাদের পরীক্ষা করা হয়েছে তাদের অধিকাংশেরই করোনার কোনো না কোনো উপসর্গ ছিল। এছাড়া আরো কিছু মানুষের পরীক্ষা করা হয়েছে যারা করোনা আক্রান্তদের সংর্স্পশে ছিল। কিন্তু আমরা এখন যে নতুন সংকটে পড়েছি তা হল উপসর্গহীন করোনা রোগী। এরা যেমন নিজে থেকে পরীক্ষা করাতে আসবে না তেমনি আমাদের স্বাস্থ্যখাতের বর্তমান অবকাঠামোগত যে দুর্বলতা তাতে উপসর্গহীন রোগীর পরীক্ষা করানোর বিষয়টিও প্রায় অসম্ভব।
তিনি বলেন, আমরা প্রায়ই পত্রিকায় পড়ি যে করোনা ওয়ার্ডে ভর্তিও কিছুক্ষণের মধ্যেই রোগী মারা যাচ্ছে। পর্যাপ্ত পরীক্ষা না হওয়ার কারণে করোনা পজিটিভ কিনা তা জানতে না পারাটাও এর একটা কারণ। রোগী যখন বুঝতে পারে তখন তার বা ডাক্তারদের আর কিছুই করার থাকে না। এই পরিস্থিতি ঠেকাতে হলে ম্যাসিভ আকারে করোনা পরীক্ষা বাড়াতে হবে। এর কোনও বিকল্প নেই।
বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালক ডা. বাসুদেব কুমার বলেন, এমনিতেই উপসর্গহীন রোগী নিয়ে টেনশনে আছি আমরা। তার ওপর লঞ্চ-বাস চালু হওয়ায় দেখেছেন মানুষ কিভাবে ভিড় করেছে? সরকার ভাড়া বাড়িয়ে দিয়েছে তারপরও গাদাগাদি করে লোক নিচ্ছে লঞ্চ বাসের মালিকরা। বাংলাদেশে সংক্রমণের মাত্রা বেড়ে যাওয়ার নেপথ্যে সরকারি নির্দেশনা মেনে না চলাই দায়ী। এ কারণে কমিউিনিটি ট্রান্সমিশন হয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যাও বাড়ছে।
বরিশালের সিভিল সার্জন ডা. মনোয়ার হোসেন যুগান্তরকে বলেন, উপসর্গ নেই অথচ পরীক্ষা করাতে এসে পজিটিভ এমন রোগীর সংখ্যাই এখন বেশি। দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এইধরনের করোনা রোগীর সংখ্যা। কিছুদিন আগেও এটি ছিল না। এভাবে চলতে থাকলে পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাবে না। যে কোনোভাবেই হোক এটা ঠেকাতে হবে।